
চালতা গ্রামবাংলার চিরচেনা টক-মিষ্টি রসালো ফলের অজানা গল্প
“চালতা — শুধু টক স্বাদের একটি ফল নয়, এটি আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য, ভেষজ গুণে ভরপুর এক প্রাকৃতিক উপহার।”
চালতা (ইংরেজিতে Elephant Apple নামে পরিচিত, বৈজ্ঞানিক নাম Dillenia indica) আমাদের গ্রামবাংলার এক সুপরিচিত ফল। এই ফল সাধারণত গাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় বর্ষাকাল এবং শরৎকালের মাঝে। চালতা গাছটি সাধারণত ৪-১৫ মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে এবং দেখতে খুবই ঘন ও ছায়াযুক্ত হয়। চালতা ফল দেখতে বড় ও গোলাকার, বাইরের খোসা শক্ত এবং কাঁটা-কাঁটা আকৃতির হয়, যা একে অন্যান্য ফল থেকে আলাদা করে তোলে।
চালতা ফলের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর স্বাদ—টক এবং কিছুটা কষযুক্ত। অনেকেই এই ফল রান্না করে খেয়ে থাকেন, বিশেষ করে চালতার টক ঝোল বা আচার গ্রামীণ হেঁশেলের অতি পরিচিত একটি পদ। মাছ দিয়ে চালতার টক রান্না করলে তার স্বাদ আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। কিছু জায়গায় চালতা শুকিয়ে সংরক্ষণ করে পরবর্তীতে ব্যবহার করা হয়।
চালতার পুষ্টিগুণ:
১) চালতা একটি পুষ্টিকর ফল যাতে ক্যালসিয়াম,শর্করা, ভিটামিন বি,ভিটামিন সি,থায়ামিন ও রিবোফ্লাবিন সহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর উপাদান রয়েছে।
২) রক্ত পরিষ্কারক:
চালতার রস রক্ত পরিষ্কার করতে সাহায্য করে বলে মনে করা হয়।
৩) হাড় ও লিভারের জন্য উপকারী:
চালতার ক্যালসিয়াম ও শর্করা লিভারের জন্য টনিক হিসেবে কাজ করে।
৪) ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ:
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে চালতার ডায়াবেটিস প্রতিরোধক গুন রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চালতার উপকারিতা:
১) হজমের সমস্যা:
চালতা বদহজম,কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়রিয়া ও পেটের অন্যান্য সমস্যার সমাধানে সাহায্য করে।
২) রোগ প্রতিরোধ:
ভিটামিন সি ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় চালতা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে ও স্কার্ভি ও লিভারের রোগ প্রতিরোধ করে।
৩) রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ:
চালতা রক্তচাপ কমাতে ও কোলেস্টেরল মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক।
চালতায় থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট জরায়ু ও স্তন ক্যান্সার সহ বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে।
অন্যান্য উপকারিতা:
১) চালতা ঠান্ডা ও কাশি কমাতে কৃমি দূর করতে ও ত্বকের জন্য উপকারী
২) ভেষজ গুণাবলি বিবেচনায় চালতা ফল এক কথায় অনন্য। এই ফল প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে কাজ করে ও হজমের জন্য দারুণ উপকারী। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় চালতা বহু বছর ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, লিভার পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং ডায়রিয়া বা পেটের বিভিন্ন সমস্যায় উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। চালতা পাতাও ভেষজ গুণে ভরপুর—জ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো অসুখে এই পাতার রস বা নির্যাস ব্যবহার করা হয়।
৩) বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, চালতা খেলে হৃদরোগ ডায়াবেটিস ও আলসার রোগের ঝুঁকিও অনেকাংশে কমে।
ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে চালতা ফল পাওয়া যায়। এটি একটি বন্য ফল হিসেবেই পরিচিত হলেও বর্তমানে অনেকেই এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করার উদ্যোগ নিচ্ছে, কারণ এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
চালতা খাবার হিসেবে:
১) ফল দিয়ে তৈরি হতে পারে নানা ধরনের খাদ্যপণ্য যেমন—চাটনি, আচার, জ্যাম ও জেলি।
২) তরকারি:
চালতা বিভিন্ন সবজি ও মাছের সাথে মিশিয়ে তরকারি হিসেবে খাওয়া যায়।
কিছু মিষ্টি খাবারে ও চালতা ব্যবহার করা হয়।
৪) কিছু খাদ্যপ্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান চালতা থেকে প্রাকৃতিক রং ও স্বাদ গ্রহণ করে নানা খাদ্যপণ্য তৈরি করছে।
৫) চালতা খালি পেটে খেলে হজমশক্তি বাড়ে এবং ক্ষুধা বৃদ্ধি পায়।
১) চালতা অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে এসিডিটি বা গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।
২) গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বেশি খাওয়া উচিত না।
৩) যাদের হজমের সমস্যা আছে তাদেরও বেশি খাওয়া উচিত না।
৪) কিছু ক্ষেত্রে চালটা খেলে অ্যালার্জি হতে পারে।
অন্যান্য তথ্য:
১) চালতা একটি অপ্রকৃত ফল, যার মাংসল বৃত্তি খাওয়া হয়।
২) এটি ক্যালসিয়াম,ভিটামিন বি,ভিটামিন সি এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের সমৃদ্ধ।
৩) চালতা ঠান্ডা লাগা কাশি ও হজমের সমস্যা সমাধানের সহায়ক হতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, চালতা কেবলমাত্র একটি টক ফল নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য এবং গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমান সময়ে যখন প্রাকৃতিক খাদ্য ও ভেষজ পণ্যের গুরুত্ব বাড়ছে, চালতা তার মূল্য ও উপযোগিতা দিয়ে আমাদের জীবনধারায় পুনরায় জায়গা করে নিচ্ছে।

