
কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর কি কি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ?
কেমো থেরাপি (Chemo Therapy) একদিকে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য জীবন বাঁচানোর একটি কার্যকর পদ্ধতি, অন্যদিকে এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শরীর ও মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলে। চিকিৎসার এই পর্যায়ে রোগীকে সুস্থভাবে ধীরে ধীরে ফিরিয়ে আনতে হলে কিছু নির্দিষ্ট সতর্কতা মানা জরুরী। কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা দুর্বল হয়ে যায়, শরীরের ভেতরের ভারসাম্য নষ্ট হয়, মানসিক চাপ বেড়ে যায়। তাই এই সময় জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিশ্রাম এবং মানসিক শক্তি সবকিছুকেই গুরুত্ব দিতে হয়। নিচে ধাপে ধাপে কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর রোগীকে কি কি সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ জেনে নেওয়া যাক।
• কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে ছোট একটি সংক্রমণও বড় আকার নিতে পারে। তাই সংক্রমণ এড়াতে সর্বদা পরিচ্ছন্ন থাকা দরকার। তাই নিয়মিত বাইরে থেকে এসে ঘরে ঢোকার আগে পরিষ্কার হওয়া উচিৎ। অনেকে মনে করেন সাধারণ সর্দি-কাশি কোনো বড় ব্যাপার নয়, কিন্তু কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর এই ধরনের সংক্রমণও রোগীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই যাদের সংক্রমণ আছে বা যারা অসুস্থ, তাদের কাছাকাছি যাওয়া একেবারেই উচিৎ নয়।
• খাদ্যাভ্যাসে বিশেষ যত্ন নেওয়া জরুরী। কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) সময় এবং পরে অনেক রোগীর খিদে কমে যায়, খাবারের স্বাদ বদলে যায়, বমি বমি ভাব হয়। তবুও শরীরকে পুষ্টি জোগানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় হালকা ও পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিৎ। যেমন তাজা ফলমূল, সবজি, ডাল, ভাত, মাছ বা মাংস। আর অস্বাস্থ্যকর ফাস্টফুড বা রাস্তায় তৈরি খাবার এড়ানো দরকার, কারণ এগুলোতে জীবাণুর ঝুঁকি বেশি থাকে। পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খাওয়া উচিৎ, তবে জল অবশ্যই ফিল্টার করা হওয়া উচিৎ। অনেক সময় চিকিৎসক প্রোটিনের চাহিদা মেটাতে বিশেষ সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দেন, সেগুলোও মেনে চলা দরকার।
• কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর শরীর প্রায়ই দুর্বল ও ক্লান্ত অনুভব করে। তাই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া খুবই জরুরী। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো, দুপুরে কিছুটা বিশ্রাম নেওয়া শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করে। তবে অতিরিক্ত শুয়ে থাকা বা অলসতা শরীরের গতিশীলতা কমিয়ে দেয়। তাই হালকা হাঁটা বা শরীরচর্চা ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী করা যেতে পারে। এতে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাড়ে এবং মানসিক দিক থেকেও রোগী ভালো বোধ করে।
• কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে অন্যতম হল চুল পড়া, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, মুখের ভেতর ঘা হওয়া ইত্যাদি। এগুলো রোগীর আত্মবিশ্বাসকে কমিয়ে দেয় এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তাই ত্বকের যত্ন নেওয়া, হালকা ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করা, মুখ পরিষ্কার রাখা এবং প্রয়োজনে মাউথওয়াশ ব্যবহার করা দরকার। চুল পড়ে গেলে উইগ বা স্কার্ফ ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে মনে রাখা জরুরী যে এগুলো সাময়িক সমস্যা এবং কিছু সময় পরে চুল আবার গজায়।
•, কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরী। অনেক রোগী হতাশা, ভয়, একাকিত্ব এবং অনিশ্চয়তায় ভোগেন। এ সময় পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ রোগীর মনে শক্তি যোগায়। কাউন্সেলিং, ধ্যান বা প্রার্থনা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও রোগীকে সবসময় ইতিবাচক মনোভাব ধরে রাখতে সাহায্য করে।
• নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে চেকআপ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর শরীরে জটিলতা দেখা দিতে পারে, যেমন রক্তের গঠন পরিবর্তন, কিডনি বা যকৃতের (Liver) উপর প্রভাব। তাই সময়মতো পরীক্ষা করানো ও ওষুধ খাওয়া জরুরী। চিকিৎসকের নির্দেশ ছাড়া কোনো ওষুধ খাওয়া একেবারেই উচিৎ নয়।
• রোগীকে সংক্রমণ ও আঘাত থেকে বাঁচাতে কিছু দৈনন্দিন সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। যেমন দাঁত ব্রাশ করার সময় নরম ব্রাশ ব্যবহার করা, ধারালো জিনিস ব্যবহারে সাবধান হওয়া, কাটা-ছেঁড়া হলে সাথে সাথে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করা। কারণ সামান্য রক্তক্ষরণও বড় সমস্যায় রূপ নিতে পারে।
• কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর রোগীর শরীরে অনেক সময় ওজন কমে যায়, আবার কারো কারো ওজন বেড়েও যায়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। এর জন্য নিয়মিত হালকা ব্যায়াম (Exercise), সুষম খাদ্য এবং পর্যাপ্ত ঘুম খুবই কার্যকর।
• ভ্রমণ বা বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা নেওয়া দরকার। ভিড়যুক্ত জায়গা, ধুলাবালি, দূষিত পরিবেশ যতটা সম্ভব এড়ানো উচিৎ। প্রয়োজনে মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে।
• কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা মেনে চলা জরুরী, কারণ এই সময় শরীর নতুন জীবনের জন্য প্রস্তুত থাকে না। সন্তান ধারণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর সতর্কতা অবলম্বন করা মানে শুধু শারীরিক যত্ন নয়, মানসিক শক্তি বজায় রাখা এবং সঠিক জীবনধারা অনুসরণ করা। রোগীর পাশে পরিবার ও প্রিয়জনের সমর্থন এই যাত্রায় অমূল্য ভূমিকা রাখে। প্রতিটি ছোটো বিষয় পরিচ্ছন্নতা, খাবার, বিশ্রাম, মানসিক স্বাস্থ্য ও চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা একসাথে মিলেই রোগীকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনে।সুতরাং, কেমো থেরাপির (Chemo Therapy) পর সতর্কতা অবলম্বন শুধু চিকিৎসার অংশ নয়, এটি জীবনধারারও একটি বড় পরিবর্তন। ধৈর্য, ইতিবাচক মনোভাব এবং সঠিক যত্নের মাধ্যমে রোগী ধীরে ধীরে সুস্থতার পথে এগিয়ে যেতে পারে। এটাই রোগীর আত্মবিশ্বাস ও বেঁচে থাকার ইচ্ছাকে দৃঢ় করে তোলে, যা শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারকে জয় করার সবচেয়ে বড় শক্তি।

