প্রাচীন চিকিৎসা থেকে আধুনিক পুষ্টি নারকেলের (Coconut) বহুমুখী ব্যবহার
এটি এক সবুজ গাছ যার প্রতিটি অংশই কার্যকর। নারকেল গাছ যেগুলি কেবল ছায়া দেয় না এই গাছের ছাল, জল ,শাস, এমন কি পাতা পর্যন্ত বহুমূল্য সম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। নারকেল জল প্রাকৃতিক ইলেকট্রোলাইট হিসেবে কাজ করে,আর নারকেল তেল ব্যবহৃত হয় রন্ধন ও ত্বক চর্চা ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসায়।
নারকেলের বৈজ্ঞানিক নাম: Cocos nucifere.
নারকোল বিশ্বের একটি অন্যতম দরকারি গাছ ও এটিকে প্রায়ই জীবনের গাছ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।এটি মানুষ খাদ্য, জ্বালানি, প্রসাধনী,ভেষজ, ঔষধ সরবরাহ,দালান নির্মাণ, এর শক্ত খোল থেকে কয়লা ও ছোবড়া থেকে কোকোপিট তৈরি হয়।এর শক্ত বহিরাবরণ ছোবড়া এবং লম্বা পাতা বিভিন্ন জিনিস ও সাজসজ্জা তৈরির উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর থেকে প্রাপ্ত তেল ও দুধ সাধারণত রান্নায় ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে কোন কিছু ভাজায়;পাশাপাশি সাবান ও প্রসাধনীয় তৈরি হয়।
নারকোলের ব্যবহার:
নারকেল নানা রকম ভাবে খাওয়া যায়। যেমন কাঁচা নারিকেল, নারকেল তেল,নারকেল দুধ,নারকেলের নাড়ু, নারকেলের সন্দেশ,নারকেল দিয়ে পিঠা ইত্যাদি আরো বহু জিনিস বানানো যায়।
নারকেলের গুঁড়ো দিয়ে বেক করা যায়।
যে কোন রান্নার রেসিপিতে আপনারা সহজেই তেলের পরিবর্তে নারকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন।
রান্নার ক্ষেত্রে,ভাজা নারকেল তেল ভাজা ও তরকারির মত খাবারে একটি সুন্দর গ্রীষ্মমন্ডলী নারকেলের স্বাদ যোগ করে।
ক্রিমারের পরিবর্তে আপনারা কফিতে দুগ্ধ মুক্ত নারকেল দুধ যোগ করতে পারেন।
নারকেল তেল দিয়ে গ্যাসের উপরে পপকন বানানো যায়।
নারকেল দুধের দই চেষ্টা করে দেখুন যা বিভিন্ন স্বাদে পাওয়া যায়।
নারকেলের শক্ত শাস,দুধের মত সাদা ও বেশ সুস্বাদু। এর শাস বিভিন্ন প্রকার পিঠা তৈরিতে, মিষ্টি বিস্কুট, চকলেট, বিবিধ রান্নায় ব্যবহার্য। শুকনো নারকেলের গাছ থেকে তৈরি উদ্ভিদ তৈল মাথায় ব্যবহার ছাড়াও রান্নায় সাবান শ্যাম্পু ও অন্যান্য প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। নারকেলের ছোবড়া দিয়ে শক্ত দড়ি, ব্রাশ,জাজিম ,পাপোশ তৈরি করা হয়। নারকেলের খোল দিয়ে তৈরি হয় হুঁকো। কাঁচা ও শুকনো পাতা দিয়ে মাদুর ও ঝুড়ি তৈরি ও কুঁড়েঘর ছাওয়া যায়। পাতার মধ্যশিরা দিয়ে ঝাঁটা তৈরি করা যায়। কচি নারকেলকে ডাব বলা হয়।ডাবের জল সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। গাছের কান্ড দিয়ে ঘরের আড়া, পুলের খাম্বা,ঘরের খুঁটি, বর্শা তৈরি করা হয়।
নারকেল:এটি একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার
নারকেলে আছে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন খনিজ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান। এটি আমাদের শরীরের জন্য নানাভাবে উপকারী। ১০০ গ্রাম নারিকেলে প্রায় ৩৫৪ ক্যালোরি, ৩৩ গ্রাম ফ্যাট,২০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম,৩৫৬ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম,১৫ গ্রাম কার্বোহইড্রেট, এবং ৩.৩ গ্রাম প্রোটিন থাকে। এছাড়াও, এতে ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি-৬, এবং বি-১২ রয়েছে।
ভিটামিন:
নারকেলে ভিটামিন সি ভিটামিন বি, সি ও ভিটামিন বি -12 পাওয়া যায়।
খনিজ:
নারকেলে আয়রন,ম্যাগনেসিয়াম, দস্তা, ত্তামা, ম্যাঙ্গানিজ ,ও সেলেনিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ থাকে।
ফাইবার:
নারকেলে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে।যা হজম ক্ষমতা উন্নত করে ও হৃদরোগের ঝুঁকিও কমায়।
ফ্যাট:
নারকেলে প্রধানত স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে ,যা ভালো কোলেস্টেরল ( HDL)এর মাত্রা বাড়াতে সহায়ক।
অন্যান্য উপাদান:
নারকেল তেল লরিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ যা আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও রয়েছে যা শরীরের কোষগুলিকে ফ্রি রেডিক্যাল থেকে রক্ষা করে।
আমাদের ত্বক ও চুলের জন্য নারকেলের অন্যান্য ব্যবহার:
আদ্রতা বৃদ্ধি ও চুলের পতন রোধ করার জন্য চুলে তেল লাগানো উচিত। শুষ্কতা কমাতে ত্বকে তেল ঘসুন। ঘরে বসে ম্যানিকিউর করার জন্য আপনারা কিউটিকলগুলিতে তেল লাগাতে পারেন।আপনাদের ত্বকে লাগাবেন ও তারপর মেকআপ তোলার জন্য টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলবেন।
নারকেলের উপকারিতা:
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি:
নারকেলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি:
নারকেলের ফাইবার আমাদের হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে।
নারকেলে থাকা লরিক অ্যাসিড আমাদের হৃদ রোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক।
সুস্থ রক্তচাপকে সমর্থন করতে পারে:
নারকেল জল পটাশিয়ামের একটি ভালো উৎস, একটি খনিজ যা আমাদের শরীরে সোডিয়ামের মাত্রা ভারসাম্যপূর্ণ করতে ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ত্বকের স্বাস্থ্য:
নারকেল তেল ত্বকে মশ্চারাইজ করে ও ত্বককে নরম রাখতে সাহায্য করে।
সতর্কতা:
নারকেল যদিও স্বাস্থ্যকর কিন্তু,কিছু ক্ষেত্রে এর কিছু অপকারিতা রয়েছে। অতিরিক্ত পরিমাণে নারকেল খেলে বা যাদের কিছু স্বাস্থ্য সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে এটি ক্ষতিকর হতে পারে।
উচ্চ ফ্যাট ও কোলেস্টেরল:
নারকেলে প্রচুর পরিমাণে স্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে যা অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে শরীরের খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে।এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। যাদের উচ্চ কোলেস্টরেল বা হৃদরোগের সমস্যা আছে, তাদের নারকেল সীমিত পরিমাণে খাওয়া উচিত।
ওজন বৃদ্ধি:
নারকেলে ক্যালরি ও ফ্যাট বেশি থাকার কারণে অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে ওজন বাড়তে পারে।যারা ওজন কমাতে চান বা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান তাদের নারিকেল খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।
এলার্জি:
কিছু মানুষের নারকেলের প্রতি এলার্জি হতে পারে।তাদের ক্ষেত্রে নারকেল বা নারকেল থেকে তৈরি যে কোনো খাবার খেলে শরীরে অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া দেখা যেতে পারে।যেমন – চুলকুনি, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি।
কিডনির সমস্যা:
নারকেল জলে পটাশিয়াম বেশি থাকে যাদের কিডনির সমস্যা আছে তাদের জন্য বেশি পরিমাণে নারকেল জল ক্ষতিকর হতে পারে।কারণ বেশি পটাশিয়াম কিডনির উপর চাপ সৃষ্টি করে।
হজম সংক্রান্ত সমস্যা:
অতিরিক্ত নারকেল খেলে কারো কারো হজমের সমস্যা হতে পারে। যাদের হজম ক্ষমতা দুর্বল তাদের ক্ষেত্রে নারকোল হজম হতে সময় লাগতে পারে ও পেটে ব্যথা বা অস্বস্তি হতে পারে।
দাঁতের সমস্যা:
নারকেল খাওয়ার পর ভালোভাবে দাঁত পরিষ্কার না করলে দাঁতে ক্যাবেজ বা অন্যান্য সমস্যা হতে পারে, কারণ নারকেলের মধ্যে থাকা চিনি ও ফাইবার দাঁতে আটকে থাকতে পারে। বিশেষভাবে যাদের উপরোক্ত স্বাস্থ্য সমস্যা গুলি রয়েছে তাদের নারকেল খাওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
সারাংশ:
দুধ থেকে শুরু করে জল দই ও ময়দা পর্যন্ত নারকেলজাত পণ্যগুলি পরিমিত পরিমাণে আপনার খাদ্য তালিকায় একটি স্বাস্থ্যকর সংযোজন হতে পারে।নারকেল ক্যালরি ও চর্বিতে সমৃদ্ধ হতে পারে, বিশেষ করে স্যাচুরেটেড ফ্যাট।